বঙ্গবন্ধুর জন্ম, শৈশব ও কৈশোর

মিশন একাত্তর

বঙ্গবন্ধুর জন্ম

টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করে এক সন্তান- যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম শেখ সাহারা খাতুন। শেখ মুজিব পিতামাতার ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় এবং প্রথম পুত্র সন্তান। বাবা-মা আদর করে তাঁকে ‘খোকা’ নামে ডাকতেন বলে খোকা নামেই বাড়িতে ও গ্রামের আশেপাশের সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা ৪ বোন ২ ভাই। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় নোয়াখালী নিবাসী পন্ডিত সাখাওয়াৎ উল্লাহ নামক গৃহ শিক্ষকের হাতে। খোকার শৈশবকাল টুঙ্গিপাড়াতেই কাটে। টুঙ্গিপাড়া গোপালগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। খোকা জন্মের সময় কিন্তু গোপালগঞ্জ জেলা ছিল না- ছিল মহকুমা। এই মহকুমা তখন ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছিল।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়া নাম করনের বিশাল এক ইতিহাস আছে। স্বনাম ধন্য শিশুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদ্দিন এর লেখা “বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান” বইটিতে শুরুতেই টুঙ্গিপাড়া নামকরণের সুন্দর একটি বর্ণনা দিয়েছেন।

ঘাঘোর ও মধুমতীর জলাভূমি টুঙ্গিপাড়া

হিমালয়ের আদুরী কন্যে গঙ্গা। গঙ্গার মৃত্যু নেই। কতবার ভূমিকম্প হলো, পাহাড়ে ধস নামলো, ঝড় বইলো পর্বত-টিলায়, গঙ্গা আগের মতোই বইছে। কত জনপদের ওপর তার ভালোবাসার স্রোত, সেই স্রোতের ফল্গুধারায় বিকশিত ভারত-বাংলার ঘর-গেরস্থি।
গঙ্গা সেই আদিকালের ঐশ্বরিয়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কখনো স্বরূপ পাল্টায়নি। কিন্তু প্রকৃতিজনের আবাস ভূমিকে নববধূর মতো ঘোমটা খুলে বার বার নতুন নাম ধারণ করেছে। নদীর খাল-বিল স্রোত ধারায় এই রূপকুমারীর নানা নাম। তাই বলে জননী হিমার দেখা গঙ্গা শব্দটি কখনো বাদ পড়েনি।
হিমালয়ের তালপুঁথিতে নবগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা, বিজয়গঙ্গা, রামগঙ্গা, মহাগঙ্গা, আচনীগঞ্জ, গঙ্গালিয়া, গঙ্গাসাগর, সু-গঙ্গা, বুড়োগঙ্গা, গঙ্গাধর, ঋষিগঙ্গা, হনুগঙ্গা, পেনগঙ্গা, ওয়েনগঙ্গা, দামনগঙ্গা, গঙ্গাবলী ও দ্বিতীয় গঙ্গার কুলুজি পাওয়া যায়। গঙ্গার জন্ম ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। রাজা সাগর, ইন্দ্র, কপিল মুণি, ভগীরথ ও মহাদেব-এর উৎস স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালেও তার অবাধ বিচরণ-একারণেই গঙ্গা আবার ত্রিপথগা।
দ্বিতীয় গঙ্গার দুহিতা পদ্মাবতী রাতের অন্ধকারে বঙ্গের পশ্চিমকূলে প্রবেশ করে তার জানান দেয়। আজো পদ্মা প্রবাহিত কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট দেয়াল তার চলার গতিকে ক্ষীণতর করেছে। তার নাতনী মধুমতীও রূপ-যৌবনে বিগতা। তবুও তার স্রোতধারা জলটলমলে ধাবিত। পাটগাতী হয়ে মধুমতী গেছে দক্ষিণে, আর দক্ষিণে হাজারো গাঁও গেরাম ধুইয়ে সাগরে-মহাসাগরে। পদ্মাবতীর যুদ্ধবাজ এক সন্তানের নাম আড়িয়াল খাঁ। আড়য়িাল খাঁর একটি শাখা ভাঙ্গা-টেকেরহাট ও রাজৈর হয়ে বাইগ্যার বিলের মধ্যে পতিত হয়েছে। এই স্রোতধারার প্রাচীন রাজধানী কোতয়ালীপাড়ায় বয়ে যাওয়া নাম ঘাঘোর নদী। এই ঘাঘোরও জল থৈ-থৈ মগ্ন থেকে মিশেছে পাটগাতীর মোহনায়।
পশ্চিমে মধুমতী আর পূর্বে ঘাঘোর নদী। মাঝ বরাবর জলাভূমি। টঙ থেকে টুঙ্গি, জনবসতি গড়ে ওঠার পর টুঙ্গিপাড়া।
টুঙ্গিপাড়ার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। নীহার রঞ্জন রায় তার একটি গ্রন্থে বলেছেন-এ অঞ্চল খাঁড়িতে জেগে ওঠা নতুন জলাভূমি। তবে টুঙ্গিপাড়ার কপাল ভালো- পূর্ব-পশ্চিমে দুটি নদী। মোহনা তার পাটগাতী। একসময় পাটগাতীতে স্টিটমার চলতো। তবে নদীবিধৌত বলে নৌকা ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন।
পঞ্চাশ বছর আগে টুঙ্গিপাড়াকে আগলে রেখেছিল একটি খাল। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটিই ছিল চলাচলের জলপথ। পাটগাতী ও গোপালগঞ্জ কিংবা খুলনা যেতে হলে টুঙ্গিপাড়া থেকে চড়তে হতো গয়না বা একমাল্লাই বা দুমাল্লাই নৌকায়। কে এই জলাভূমির টুঙ্গিপাড়ায় প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল, তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। সেই পঞ্চাশ বছর আগে টুঙ্গিপাড়া ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। উত্তরে ছোট নদী বাইগ্যা।
সম্প্রীতিতে গড়া ছিল টুঙ্গিপাড়া। ঈদ, পূজা পার্বন, যাত্রাপালা, কবিগান, গাজীর গান এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতো সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। হিংসা বিদ্বেষ ও রেসারেষি কোনোকিছুই ছিল না সেকালে। তবে গ্রামের বনেদি পরিবার কাজী ও শেখদের কলহ ছিল অনেককাল আগে থেকেই। মানুষ খুন করে শেখদের শায়েস্তা করেছিল কাজীরা। দীর্ঘকাল মামলা চালানোর ফলে শেখদের বিজয় ঘটে। কিন্তু তারা সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। শেখ ও কাজীরা উভয় নিকট আÍীয়। শেখেরা কাজীদের ভাগ্নে সম্পর্কীয়।
সেই টুঙ্গিপাড়া এখন বাঙালির তীর্থস্থান। কারণ এ গ্রামের কাজল কালো মাটিতে শুয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠসন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর মুখ দেখেছিলেন। টুঙ্গিপাড়া সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ধারণ করে আজ শ্রেষ্ঠজননী।
এই টুঙ্গিপাড়ায় আরো শুয়ে আছেন শেখ বংশের পূর্বপুরুষেরা তথা বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষেরা। এঁদের মধ্যে শেখ বোরহানউদ্দিন, শেখ আকরাম, শেখ জাকির হোসেন, শেখ আবদুল হামিদ, বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর ও মা সাযেরা খাতুন প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়

এক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বংশ পরিচয় উপস্থাপন করা অপরিহার্য মনে হয়। আজ থেকে প্রায় সোয়া পাঁচশ’ বছর আগেকার কথা। তখন এই উপমহাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বহু পীর, ফকির আউলিয়া এবং দরবেশদের আগমনের জোয়ার। বঙ্গীয় গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকাতেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। এরই জের হিসেবে ইংরেজী ১৪৬৩ খ্রীস্টাব্দে নাগাদ বঙ্গীয় এলাকায় সুদূর বাগদাদের হাসানপুর থেকে এসে হাজির ছিলেন হজরত বায়জিদ বোস্তামী (রঃ)। ইনি আস্তানা হিসেবে বেছে নিলেন শহর চাঁটিগা বা চট্টগ্রাম। তাঁর সঙ্গে আগত শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়াল। বছর কয়েকের মধ্যে শেখআউয়াল এদেশকে আপন করে নিলেন। ভালোবসলেন এ বাংলার মাটিকে- বিয়ে করলেন ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। জীবন সায়াহ্নে দরবেশ শেখ আউয়াল একাকী গেলেন বাগদাদ পরিভ্রমণে। বাংলার বুকে রেখে গেলেন স্ত্রী-পুত্র পরিজনদের। কিন্তু দরবেশ আউয়াল আর সোনারগাঁয়ে ফিরতে পারলেন না। বাগদাদেই তাঁর ইন্তেকাল।

কাজী লতিফুর রহমান ও শাহজাহান বিন মোহাম্মদ কৃত ‘শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থের তথ্য মোতাবেক দরবেশ শেখ আউয়াল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহ্যবাহী বংশের সূত্রপাত। শেখ আউয়ালের পুত্রের নাম শেখ জহিরউদ্দিন এবং তদীয় পুত্র শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি শেখ। এঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু জানা যায় যে, শেখ জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহানউদ্দিন ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। এই ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে বিশেষ করে বাকি-বকেয়া আদায়ের তাগাদার জন্য শেখ বোরহান প্রায়ই সোনারগাঁও থেকে যাতায়াত করতেন গোপালগঞ্জ এলাকায়। এখানেই তিনি টুঙ্গীপাড়ার বনেদী পরিবার কাজী বাড়িতে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন। গিমাডাঙ্গার লাগোয়া টুঙ্গীপাড়াগ্রাম। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনের আমলে এই টুঙ্গীপাড়া অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো পাটগাতি ইউনিয়নে। প্রথমে বাইগার শাখা নদী, একটু এগিয়েই মধুমতী। দুই তীরে যেদিকে দু’চোখ যায়, শুধু সবুজের সমারোহ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখে শেখ বোরহানউদ্দিন বিমোহিত হলেন। এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পৃথকভাবে বসতবাড়ি নির্মাণ করে ব্যবসা শুরু করলেন।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ প্রবন্ধে তার বাবার জন্মের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তা তুলে ধরা হোল- (শেখ হাসিনা, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৬ আগস্ট, ১৯৯৬)
‘বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গীপাড়া। বাইগার নদী এঁকে-বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীর অসংখ্য শাখা নদীর একটি বাইগার নদী। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে।
প্রায় দু’শ বছর পূর্বে মধুমতী নদী এ গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি দূরে সরে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরও অনেক গ্রাম। সেই দুশ’ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষরা এসে নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমাম-িত ছোট্ট গ্রামটিতে তাদের বসতি গড়ে তোলেন। তাঁদের গ্রামের কৃষকদের নিয়ে অনাবাদী জমি-জমা চাষ-বাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে টুঙ্গীপাড়াকে একটি বর্ধিষ্ণু ও আÍনির্ভরশীল গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলেন। শুরুর দিকে নৌকাই ছিল যাতায়াতের একমাত্র ভরসা। পরে গোপালগঞ্জ থানায় স্টিামার ঘাট গড়ে ওঠে।
আমাদের পূর্ব পুরুষরা টুঙ্গীপাড়া গ্রামে বসতির জন্য জমি-জমা ক্রয় করেন। কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালান বাড়ি তৈরি করেন, যার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালে যে দুটো দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়। এই দালান-কৌঠা গড়ার সাথে সাথে বংশেরও বিস্তার ঘটে। আশপাশেও বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এ বাড়িতেই সংসার জীবন শুরু করেন। আর এখানেই জন্ম নেন আমার আব্বা, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আমার আব্বার নানা শেখ আবদুল মজিদ আব্বার আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদীর দুই কন্যাসন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান আমার আব্বা। আর তাই আমার দাদীর বাবা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দাদীকে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান-‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে।’
সুফি মতবাদে বিশ্বাসী এবং উদার হৃদয় আর মুক্তবুদ্ধির শেখ বোরহান মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করলেন এদের ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও লোকাচারকে। স্থানীয় গণমানুষের সঙ্গে সৃষ্টি করলেন একাÍতাবোধ। পূর্ব পুরুষদের মতো তিনিও ঘোষণা করলেন মানব প্রেমের সুমহান বাণী। হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণ্যকে বিসর্জন দিতে হবে আর শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবাসার মাঝ দিয়ে পরম করুণাময় আল্লাহকে পেতে হবে। তাই কর্মক্লান্ত দিনের শেষে আল্লাহ তায়ালার সুমধুর ‘জিকির’ ধ্বনিতে টুঙ্গীপাড়ার সাধারণ মানুষের হৃদয়ে দেখা দিলো অনাবিল প্রশান্তি। সেওতো ‘আজ প্রায় আড়াইশ’ বছর আগেকার কথা।
তা’হলে হিসাব করে একথা আজ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন, সুফি দরবেশ আউয়ালের সপ্তম বংশধর এবং শেখ বোরহানউদ্দিনের চতুর্থ অধঃস্তন পুরুষ। শেখ বোরহানের তিনপুত্র যথাক্রমে শেখ আকরাম, শেখ তাজ মাহমুদ এবং শেখ কুদ্রতউল্লাহ ওরফে কদু শেখ। বড়পুত্র শেখ আকরামের তিনপুত্রের মধ্যম হচ্ছেন শেখ হামিদ। এই শেখ হামিদের পুত্র শেখ লুৎফর রহমান (মৃঃ ১৯৭৪ খ্রীঃ) এবং তদীয় দুই পুত্র যথাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ নাসের। সংক্ষেপে এই হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বংশ পরিচয়।

শৈশব ও কৈশোর

শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যকাল টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই কাটে। টুঙ্গিপাড়া প্রথমে কোটালীপাড়া ও পরে গোপালগঞ্জ থানার অন্তর্গত ছিল। স্বাধীনতার পর টুঙ্গিপাড়াকে পৃথক থানা ঘোষণা করা হয। ষষ্ঠ শতকে কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। কে জানতো এই দক্ষিণ বাংলার আর একজন বীরসন্তান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবেন।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি শাশ্বত গ্রামীন সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা পীড়ন দেখেছেন। শিশুকালে তিনি চঞ্চল ও অন্যায়ের প্রতি আপোসহীন ছিলেন। সমাজ ও পরিবশে তাঁকে বাল্যকাল থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোন শক্তির কাছে, সে যত বড়ই হোক আÍসমর্পণ করেননি।
শেখ মুজিবুর রহমান পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে প্রথম পুত্র। তাই পরিবারে তার আদর ছিল বেশি। তিনি ছিলেন স্বল্পভোজী, নিরামিষ বেশি খেতেন। বেতাগা, ডুমুর, কাঁচা কলা ও মাছ ভালবাসতেন। কৈ, শিং, চিংড়ি ছিল তার প্রিয় মাছ। খাওয়া-দাওয়ার চাইতে খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বেশি।
১৯৩৪ তখন খোকার বয়স মাত্র চৌদ্দ। মাদারীপুরের পূর্ণদাসের অনুসারীরা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলেদের তাঁদের দলে ভেড়াতেন। বিপ্লবীদেরও নজর পড়েছিল খোকার ওপর। একটু বলে রাখা ভালো এই পূর্ণ চন্দ্র দাসের সংবর্ধনা সভায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এক মানপত্র পাঠ করেছিলেন। সেখানে বিদ্রোহী কবি ‘জয় বাংলা’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। কিশোর শেখ মুজিবের মাথায় সেখান থেকে ‘জয় বাংলা’ ঢুকে গিয়েছিল। এদিকে বেশ কিছুদিন অসুস্থতার দরুণ শেখ মুজিবের সহপাঠীরা ক্লাস এগিয়ে যায। যে কারণে ১৯৩৭ সালে খোকাকে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখানেই খোকার পড়ালেখার জন্য বাড়িতে কাজী আব্দুল হামিদ মাস্টারকে রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও দেওয়া হয়েছিল। এই হামিদ মাস্টারের নেতৃত্বে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করা হয়েছিল। সমিতির অন্যতম সংগঠক ও একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন শেখ মুজিব। সমিতি গরিব ছেলেদের সাহায্য করত। প্রতি রোববার থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুষ্টি চাল উঠিয়ে আনা হতো এবং সেই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের পড়াশোনার খরচ দেওয়া হতো। শেখ মুজিব গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরিব ছেলেদের জন্য জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। হঠাৎ করে যক্ষ্মা রোগে হামিদ মাস্টারের অকাল মৃত্যুতে খোকা খুবই কষ্ট পেয়েছিল। তারপর থেকে সেবা সমিতির পুরো দায়িত্ব খোকার ওপর বর্তায়। সকল নেতাই শেখ মুজিবকে ভালো কর্মী হিসেবে মূল্যায়ন করতেন, সবাই তাঁকে খুব øেহ করতেন। কেননা শেখ মুজিব কোনো কাজে ‘না’ বলতেন না। নেতৃত্বের হাতেখড়ি এভাবেই তার হয়েছিল।
শৈশবে শেখ মুজিব ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন। খুব ভালো খেলোয়ার না হলেও স্কুল টিমে অবস্থান ছিল ভালো। চার বছর লেখাপড়া করতে না পারায় ক্লাসের ছেলেদের চেয়ে একটু বড়োই ছিলেন। ভীষণ একগুঁয়ে শেখ মুজিবের একটা দল ছিল।
কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতেন দলবেঁধে। এতে খোকার বাবা মাঝে মধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। ছোটো শহর, সবাই সবাইকে চেনে। নালিশ যেতে বাবার কাছে। শেখ মুজিব বাবাকে ভীষণ ভয় করতেন।
১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সফল করেন। তাঁদের ভাষণ শুনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা শেখ মুজিবের জীবনের ধারা বদলে গেল। দেশ এবং দেশের দরিদ্র মানুষ তাঁকে আলোড়িত করে। পরাধীন দেশ তাঁর ভালো লাগত না। তাই তিনি কিশোর বয়সেই স্বপ্ন দেখতেন ইংরেজদের বিতাড়ন করে স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার। সেই স্বপ্নের পথ ধরে সে সময়ই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা তার প্রবন্ধ ‘আমার বাবা শেখ মুজিব’ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর শৈশব সম্পর্কে লিখেছেন-
‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপি দয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে। মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে। কোথায় দোয়েল পাখির বাসা। দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠেঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভাল লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তাঁর কথা মতো যা বলতেন তাই করত। আবার এগুলো দেখাশোনার ভার দিতেন ছোট বোন হেলেনের ওপর। এই পোষা পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝে মাঝে এ জন্য ছোট বোনকে বকাও খেতে হতো। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতি ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এ খালের পাড়েই ছিল বড় কাছারি ঘর। আর এই কাছারি ঘরের পাশে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাঁদের কাছে আমার আব্বা আরবী, বাংলা, ইংরেজী ও অংক শিখতেন।
আমাদের পূর্ব পুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাভাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূর। আমার আব্বা এই স্কুলেই প্রথম লেখাপড়া করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুল থেকে ফেরার সময নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর আমার দাদি আর তাকে ঐ স্কুলে যেতে দেন নাই।’

শৈশবের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা

১৯৪০ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিলাস বাবু। স্কুলের মাঠে ছাত্রদের সভা হবে। তখন গোপালগঞ্জে রাজিৈনতক নেতা ছিলেন খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ এমএলএ ও তাঁর জামাত অহিদুজ্জামান ঠান্ডা মিয়া। অহিদুজ্জামানের পিতা আবদুল কাদের মোক্তার ছাত্রসভা হতে দেবেন না। তিনি এসডিও-কে দিয়ে সভা বন্ধ করান। ছাত্ররা মসজিদের কাছে সভা করে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে কোর্ট থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
আর একবার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম গোপালগঞ্জে জনসভা করেন। তখন একটি গোলযোগের অভিযোগে আবদুল কাদের মোক্তারের বিরোধিতার ফলে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এক সপ্তাহ কারাগারে কাটিয়ে তিনি মুক্তি লাভ করেন। স্কুল জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ ওয়ান্ডারার্স ফুটবল টিমে খেলতেন। একজন খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর দলীয় ছবি আছে।

তিনি গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ব্রতচারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি স্কুলের ছাত্র ও পাড়া-প্রতিবেশী ছেলেদের নিয়ে ব্রতচারি নাচ-গান করতেন। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হতো-
“ও আমার বাংলাদেশের মাঠি
তোমায় রাখব পরিপাটি”
ছোটবেলা থেকে তিনি দানশীল ও উদার ছিলেন। একবার গ্রামে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। গ্রামের লোক অনাহারে। তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠলো। তাঁদের ঘরে গোলাভরা ধান। তিনি গোলার ধান দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করেন। গরিব ছাত্র ও গরিবদের জন্য তিনি সহপাঠীদের নিয়ে মুষ্টি ভিক্ষা করতেন। তাঁর চাচা খান সাহেব শেখ আব্দুর রশিদ নসু মিয়া এবং তাঁর পুত্র খান সাহেব শেখ মোশারেফ হোসেন হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানকে স্নেহ করতেন। তাঁরা উভয়েই পাটগাতি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সমাজসেবামূলক কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
স্কুল জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটিরও সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯৪০ সালের জুন-জুলাই মাসে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে গোপালগঞ্জ ছাত্রদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম কলঙ্কিত করার জন্য মিঃ হলওয়েল ১৭৫৬ সালে ১৫৬ জন ইংরেজ বন্দীর মৃত্যুর স্মরণে কলকাতায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন এবং সে স্মৃতিস্তম্ভ হলওয়েল মনুমেন্ট নামে পরিচিত ছিল। হলওয়েল মনুমেন্ট জাতীয় পরাধীনতার চিহ্নস্বরূপ। তাই সুভাষ চন্দ্র বসু হলওয়েল মনুমেন্ট সরিয়ে নেয়ার জন্য সারা বাংলায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৩৯ সালে অষ্টম ও ১৯৪০ সনে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। গোপালগঞ্জ শহরের রসরঞ্জন সেনগুপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাড়ি গিয়ে পড়তেন। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ম্যাট্রিক পাস করেন। একদিকে বেশি বয়সে স্কুলে ভর্তি, অন্যদিকে বেরিবেরি রোগে ৩ বছর পড়া বন্ধ থাকায় তিনি ২২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন।

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles